পদার্থবিদ্যা বা পদার্থবিজ্ঞান হল বিজ্ঞানের একটি বিস্তৃত ক্ষেত্র যা শক্তি, পদার্থ, বিদ্যুৎ ইত্যাদির বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যার পাশাপাশি তাদের মধ্যকার সম্পর্ক অন্বেষণ করে। পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব এবং সূত্রগুলি, একটি সিস্টেম বা ঘটনার প্রাকৃতিক পরামিতি এবং আচরণগুলিকে চিহ্নিত করতে এবং ব্যাখ্যা করতেও ব্যবহার করা হয়।
সভ্যতার শুরুতে যখন পদার্থবিজ্ঞানের প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়, তখন এটি জ্যোতির্বিদ্যা, আলোকবিদ্যা এবং বলবিদ্যা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যা জ্যামিতি বিজ্ঞানের মাধ্যমে তাত্ত্বিকভাবে সম্পর্কিত। ব্যাবিলনীয় এবং হেলেনিস্টিক দার্শনিক যেমন আর্কিমিডিস এবং টলেমি প্রাচীনকালে এই পরিমাণগত বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ অবদান রেখেছিলেন।
[ পদার্থবিদ্যা – কী, কেন, কিভাবে? ]
পদার্থবিজ্ঞানের প্রাচীনতম ক্ষেত্রগুলির মধ্যে একটি হল শাস্ত্রীয় পদার্থবিদ্যা। এটি গতিশীল সবকিছুর সাথে সম্পর্কিত। ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার লক্ষ্য হল সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণায়মান গ্রহ এবং একটি নিয়মতান্ত্রিক ফ্যাশনে দুলতে থাকা ঘটনা ব্যাখ্যা করা।
থার্মোডাইনামিক্স বা তাপগতিবিদ্যা, কোয়ান্টাম মেকানিক্স , অপটিক্স বা আলোকতত্ত্ব, কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ব, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স বা পারমানবিক পদার্থবিদ্যা, মেকানিক্স বা বলবিদ্যা, তরঙ্গতত্ত্ব, রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতা এবং ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম বা তাড়িতচৌম্বকত্ব হল পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে মৌলিক ক্ষেত্রগুলির মধ্যে কয়েকটি।
তাপগতিবিদ্যা প্রকৃতপক্ষে কোন সিস্টেমে তাপমাত্রা, চাপ এবং আয়তনের পরিবর্তনের প্রভাব এবং তাপে শক্তি স্থানান্তরের উপর গবেষণা করা হয়। আদিম বাষ্প ইঞ্জিনের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য বিজ্ঞানীদের কয়রা অনুসন্ধান তাপগতিবিদ্যার বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখে। ফরাসি বিজ্ঞানী সাদি কার্নো বাষ্প ইঞ্জিনের কার্যকৌশল ব্যাখ্যা করেন এবং তার এই উদ্ভাবনের জন্য তাকে তাপগতিবিদ্যার জনক বলা হয়।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স পরমাণু এবং অণুর স্তরে সিস্টেমের ভৌত দিকগুলি বোঝার জন্য মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক কাঠামো। সমস্ত কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা, কোয়ান্টাম রসায়ন, কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি এবং কোয়ান্টাম তথ্য বিজ্ঞান এই ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রতিষ্ঠাতা স্তম্ভ হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং তাকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জনক বলা হয়।
আলোকবিদ্যায় দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান সকল ধরণের আলো নিয়েই গবেষণা কয়রা হয়। আলোকবিদ্যায় প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যাতিচার এবং অপবর্তনের মতো আলোকীয় বৈশিষ্ট্যের আলোচনা করা হয়। ইবন আল-হাইথাম আলোকবিদ্যায় তার আবিষ্কারের জন্য সুপরিচিত ছিলেন।তিনি এই তত্ত্ব দেন যে, কোন বস্তু থেকে আগত রশ্মি চোখে প্রবেশ করবার পর তা দেখা যায়। পরবর্তিতে প্রমাণিত হয় যে বস্তু আলো প্রতিফলিত করে এবং চোখের রেটিনায় প্রবেশ করলে তা দর্শণানুভূতি সৃষ্টি করে। আলো দ্রুততম গতিতে ভ্রমণ করে।
কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ব হলো মহাবিশ্বের উৎপত্তি, এর বৃহৎ আকারের কাঠামো এবং গতিবিদ্যা এবং মহাবিশ্বের আসন্ন মৃত্যু, সেইসাথে এই বিষয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণকারী বিষয়গুলোর আলোচনা। অ্যানাক্সিম্যান্ডারকে সৃষ্টিতত্ত্বের জনক বলা হয়।
পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা হল পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা যেখানে পারমাণবিক কণা এবং তাদের মিথস্ক্রিয়া, তেজষ্ক্রিয় পদার্থের অর্ধায়ু, তেজষ্ক্রিয়তা সম্পর্কিত আলোচনা করা হয়।আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের সোলার সিস্টেম পারমাণবিক মডেল, আলফা কণা, বিটা কণা এবং প্রোটনের ব্যাখ্যা পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানকে অনেকটুকু এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।
পারমাণবিক শক্তি বিদ্যুতের সবচেয়ে বড় উৎস হতে পারে এবং আধুনিক বিশ্বের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিচালনা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং সঠিক প্রকৌশল ও যত্নের সাথে রক্ষণাবেক্ষণ না করা হলে তা অনেক বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। আবার, পারমাণবিক অস্ত্রগুলি যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় যা বিজ্ঞানের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং জঘন্য ব্যবহার নির্দেশ করে।
মেকানিক্স হল গণিত এবং পদার্থবিদ্যার মিলিত একটি শাখা যা বস্তুগত সত্তার মধ্যে বল, পদার্থ এবং গতির মিথস্ক্রিয়া আলোচনা ও ব্যাখ্যা করে। কোনো বস্তুর উপর বল প্রয়োগের ফলে এর স্থানচ্যুতি ঘটে এবং তার আকার আকৃতিতেও পরিবর্তন ঘটতে পারে। মেকানিক্স যন্ত্রপ্রকৌশল এবং পুরকৌশলে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনে আবশ্যকীয় ভূমিকা পালন করে।
কম্পন হল কোন বস্তুর পর্যাবৃত্তিক আন্দোলন যেখানে বস্তুটি তার সাম্যাবস্থানের একদিকে পূর্ণ পর্যায়কালের অর্ধেক অময় এবং বাকি অর্ধেক সময় সাম্যাবস্থানের অপর পার্শ্বে থাকে। শব্দ তরঙ্গ নিয়েও তরঙ্গতত্ব্বে আলোচনা করা হয়ে থাকে।
“আপেক্ষিকতা” ধারণাটি সাধারণভাবে বোঝায় কিভাবে কোন বস্তু অন্যান্য বস্তুর সাথে সংযুক্ত। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এই বলে যে সময় এবং স্থান পরম নয় বরং তা আপেক্ষিক। এই তত্ত্বে দুটি ভিন্ন ধরণের আপেক্ষিকতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে, একটি আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব এবং অন্যটি আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব।
তাড়িতচৌম্বক বল, বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত কণার (ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক আধান) মধ্যে উদ্ভূত বিভিন্ন ধরণের মিথস্ক্রিয়া তড়িৎচুম্বকত্ব বিজ্ঞানে আলোচনা করা হয়। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল যিনি একজন স্কটিশ পদার্থবিদ ছিলেন তিনি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তত্ত্বের বিকাশের জন্য সুপরিচিত।
পদার্থবিজ্ঞান আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অভিকর্ষ থেকে শুরু করে শতকোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত নক্ষত্রের আলোচনা, ঘর্ষণের ফলে সৃষ্ট সমস্যা, সুবিধা, তাপশক্তিকে ব্যাবহার করে নিত্যনতুন যন্ত্র তৈরি, তেজষ্ক্রিয়তাকে ব্যাবহার করে মানবকল্যাণ সবকিছুর পেছনে পদার্থবিজ্ঞান ও অসংখ্য পদার্থবিদদের অসীম অবদান রয়েছে।
আরও পড়ুন:
3 thoughts on “পদার্থবিদ্যা – কী, কেন, কিভাবে?”